আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা শিবির। সেখানে শুধু হাতে হাতে শুধু অস্ত্র-গুলিই মিলছে না, রীতিমতো লাশ পড়ছে। সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে একর পর এক। কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে তিন তরুণকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় আহত হয়েছেন আরও সাতজন।
সোমবার ভোরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানান রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক মো. ইকবাল। নিহত রোহিঙ্গা তরুণরা হলেন, মো. ইলিয়াছ, মো. ইছহাক ও ফিরোজ খাঁন।
এদিকে, মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) শীর্ষ নেতা শহিদুল ইসলাম ওরফে মৌলভী অলি আকিজসহ সংগঠনটির পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
সোমবার র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন।
রোববার মধ্যরাতে উখিয়া উপজেলার মধুরছড়া ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত একটি পরিত্যক্ত ঘরে অভিযান চালানোর কথাও জানান তিনি।
মৌলভী অলি আকিজ ছাড়া অন্য গ্রেপ্তাররা হলেন, ৬ নম্বর ক্যাম্পের মৌলভী আনোয়ারের ছেলে মো. ফয়সাল ওরফে মাস্টার ফয়সাল (২৮), ২০ নম্বর ক্যাম্পের মৃত মৌলভী রহমত উল্লাহর ছেলে হাফেজ ফয়জুর রহমান (২৪), ৮ নম্বর ক্যাম্পের মৃত করিম উল্লাহর ছেলে মো. সালাম ওরফে মাস্টার সালাম (২০) ও ২২ নম্বর ক্যাম্পের আনু মিয়ার ছেলে মো. জুবায়ের (২৪)।
অভিযানে বিদেশি একটি পিস্তল, দেশীয় দুটি বন্দুক, ১০টি কার্তুজ, দুই কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, তিনটি মোবাইল ফোন এবং নগদ আড়াই হাজার টাকা পাওয়া গেছে।
র্যাবের এ অধিনায়ক জানান, গ্রেপ্তারদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা, সেভেন মার্ডার, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ এবং হত্যা, অস্ত্র, অপহরণসহ ২১টির বেশি মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, র্যাবের কাছে গোয়েন্দা তথ্য ছিল, আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী দীর্ঘ সময় ধরে মিয়ানমারে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকলেও গত ১৯ মে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফেরেন। আরসার শীর্ষ কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওস্তাদ খালেদের নির্দেশনায় তিনি ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারের নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে।
তিনি জানান, রোববার মধ্যরাতে উখিয়া উপজেলার ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার শীর্ষ নেতা মৌলভী আকিজসহ ৮-১০ জন আরসা সদস্য আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত একটি পরিত্যক্ত ঘরে গোপন বৈঠক করছেন, এমন খবর পেয়ে র্যাবের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আরসার সদস্যরা অতর্কিত গুলি ছুড়তে থাকেন। আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। পরে সেখান থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মৌলভী অলি আকিজ ২০১৭ সালে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ৫ নম্বর ক্যাম্পে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে কাজ করায় ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে তিনি রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারেও তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ নেন।
এ ছাড়া ২০২২ সালে গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের মাদকবিরোধী যৌথ অভিযানের সময় আরসা সন্ত্রাসীদের হামলায় গোয়েন্দা সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। এ সন্ত্রাসী হামলায় একজন র্যাব সদস্য গুরুতর আহত হন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন।
তার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় ১৩টি হত্যা, একটি অস্ত্র, দুটি অপহরণ, দুটি হামলা, একটি ডাকাতি এবং বিস্ফোরক আইনে একটি মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধে সর্বমোট ২১টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার বাকি চারজনও আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তারদের উখিয়া থানায় হস্তান্তরের তথ্য জানিয়ে র্যাব অধিনায়ক বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন কারণে ২০২৩ সালে ৬৪ জন এবং ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত ২০ জন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর জের ধরে র্যাব অভিযান চালিয়ে ১১২ জন আরসা শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তাদের কাছ থেকে ৫১ দশমিক ৭১ কেজি বিস্ফোরক, পাঁচটি গ্রেনেড, তিনটি রাইফেল গ্রেনেড, ১০টি দেশীয় তৈরি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১৩টি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৪টি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, ১৬৮ রাউন্ড গুলি বা কার্তুজ, ৬৭ রাউন্ড খালি খোসা, চারটি আইইডি ও ৪৮টি ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে।