আবারও বড় ধরনের দরপতন চলছে দেশের শেয়ারবাজারে। গত দুই দিনে লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ শেয়ারেরই দাম কমেছে। তাতে অনিবার্যভাবে সূচক যেমন কমেছে, তেমনি লেনদেন কমে আবারও ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি নেমে এসেছে।
গতকাল বুধবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৮ পয়েন্ট বা ১ শতাংশ কমেছে। এ নিয়ে গত দুই দিনে এ সূচকের ১৪০ পয়েন্ট বা প্রায় আড়াই শতাংশ পতন হয়েছে। তাতে সূচকটি কমে ৫ হাজার ৫২৭ পয়েন্টে নেমে গেছে। গত ২৫ এপ্রিলের পর এটিই ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক গতকাল ১০৫ পয়েন্ট বা পৌনে ১ শতাংশের মতো কমেছে। তবে চট্টগ্রামের বাজারে ঢাকার মতো লেনদেনে বড় পতন ঘটেনি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমে যেখানে নেমেছে (সাড়ে ৫ হাজার পয়েন্ট) সেটিকে একটি মনস্তাত্ত্বিক সীমাও বলা যায়। সাধারণত শেয়ারসূচক এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সীমার নিচে বা আশপাশে নেমে এলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে ভীতি দেখা দেয়। আতঙ্কে তাঁদের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তখন ভালোমন্দ–নির্বিশেষে হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দেন অনেক বিনিয়োগকারী।
গতকালও বিনিয়োগকারীদের ভালো শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। যে কারণে এদিন ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে গতকাল সূচকের বড় পতনের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, রেনেটা, লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট ও গ্রামীণফোনসহ স্থানীয় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বীকন ফার্মা, পূবালী ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিংস, বেক্সিমকো ফার্মা ও ওরিয়ন ফার্মার। এই ১০ কোম্পানির শেয়ারের দরপতনের কারণেই বুধবার ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে ৩০ পয়েন্ট (মোট পতন ৫৮ পয়েন্ট)। অর্থাৎ এদিন ডিএসইএক্স সূচকটি যতটা কমেছে, তার অর্ধেকের বেশিই কমেছে এই ১০ কোম্পানির দরপতনে। অথচ এগুলোর বেশির ভাগই দেশের শেয়ারবাজারে ভালো মানের কোম্পানি হিসেবে পরিচিত।
সর্বনিম্ন দামে ভালো কোম্পানি
ডিএসইতে গতকাল ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারের বাজারমূল্য সাড়ে ৯ টাকা বা আড়াই শতাংশের বেশি কমেছে। তাতে কোম্পানিটির শেয়ারদর কমে ৩৫৪ টাকায় নেমেছে। ডিএসইর ওয়েবসাইটে শেয়ারের দামের দুই বছরের তথ্য পাওয়া যায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, এদিন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারের দাম গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। যদিও বাজার–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১০ বছরের মধ্যেই কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানিটির শেয়ারের দাম গত মঙ্গলবার সাড়ে তিন টাকা ও গতকাল আরও সাড়ে ৯ টাকা কমেছে। গতকালের বড় এ দরপতনের পেছনে প্রধান কারণ ছিল কোম্পানিটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য। তাতে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি–মার্চ) কোম্পানিটির আয় ও মুনাফা উভয়ই কমেছে। কোম্পানিটির গত কয়েক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে জানা যায়, গত ১০ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম কোম্পানিটির মুনাফা কমার ঘটনা ঘটেছে।
বাজার–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতিতে যতই অনিশ্চয়তা থাকুক, সাধারণত সিগারেটের বিক্রি কমে না। এ কারণে বছর বছর দাম বাড়ানোর পরও দেখা যায়, সিগারেট কোম্পানির মুনাফা বাড়ে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর এবার ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে। গত বছরের জানুয়ারি–মার্চের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে কোম্পানিটির আয় কমেছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো। তারই প্রভাবে গতকাল বাজারে এই কোম্পানির শেয়ারের দামে বড় পতন ঘটে।
বড় দরপতনের কারণে শেয়ারবাজারের আরেক ভালো কোম্পানি স্কয়ার ফার্মার দামও গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। গতকাল কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ২ টাকা ২০ পয়সা বা ১ শতাংশ কমে ২০৭ টাকায় নেমেছে। অথচ গত বছরের শেষে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ১০০ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিয়েছিল। তারপরও বাজারে এ শেয়ারের দরপতন চলছে।
এ ছাড়া দরপতনের ধারাবাহিকতায় রেনেটা, গ্রামীণফোন, বীকন ফার্মা, লাফার্জহোলসিম ও পূবালী ব্যাংকের মতো ভালো মানের অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম কমে গত দুই বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
বাজার–বিশ্লেষকেরা বলছেন, কয়েক মাস ধরে দেশের শেয়ারবাজার কারসাজি নির্ভর হয়ে পড়েছে। ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মান ও ভিত্তির কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এসব শেয়ারের মধ্যে রয়েছে লাভেলো আইসক্রিম, গোল্ডেনসন, নাভানা ফার্মা, আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ই–জেনারেশন, কোহিনূর কেমিক্যালস ইত্যাদি। এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে।