গত ২১ এপ্রিল প্রথম আলো ডটকমে প্রকাশিত হয়েছিল ‘যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি সায়েম’ শীর্ষক একটি বিশেষ লেখা। এ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে একটি প্রতিক্রিয়া পাঠানো হয়েছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী তাতে সই করেছেন। এখানে সেই প্রতিক্রিয়া হুবহু তুলে দেওয়া হলো। সঙ্গে প্রতিবেদকের বক্তব্য।‘এই প্রতিবেদনে একপেশে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ইনিয়ে-বিনিয়ে বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে খাটো করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। ইতিপূর্বে ২০২২ সালের ২৫ মে “বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্টে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে তাঁরই উত্তরসূরি আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন”—এ রকম একটি তথ্য বিকৃত করে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয়। আর বানোয়াট এ তথ্য নিয়ে সেই সময় খবর প্রকাশ করে সময় টিভি, চ্যানেল আই, বাংলা ট্রিবিউন, নিউজ বাংলা ২৪ ডটকম এবং সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসসহ বিভিন্ন সরকারপন্থী মিডিয়া।বানোয়াট এসব তথ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সাহেবের ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়। পরে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম এএফপি বিষয়টির ফ্যাক্ট চেক করে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে তথ্যপ্রমাণসহ উঠে আসে যে, শহীদ জিয়াকে নিয়ে প্রচারণা আর খবর প্রকাশের বিষয়টি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতি করার অপচেষ্টা। মূল বইটিতে জিয়া সম্পর্কে এ রকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সেই একই সুবিধামতো গ্রন্থাংশ ব্যবহার করে গত ২১ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যাচার ছড়ানো হয়েছে। এখন আর বর্তমান সরকারের কোনো রাজনীতি নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে বা কবজায় নিয়ে মিথ্যা অপপ্রচারের নোংরা খেলা শুরু করেছে। আমরা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমকে নিয়ে এহেন ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যাচার, অপপ্রচার ও কুৎসায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত।বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের লেখা বই—“অ্যাট বঙ্গভবন। লাস্ট ফেজ”, যা বাংলায় মশিউল আলম অনূদিত “বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি”, আমেরিকার ইতিহাস গ্রন্থ “লাইব্রেরি অব কংগ্রেস”-এ জিয়ার আমল (১৯৭৫-৮১) পর্বে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কর্তৃক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বইয়ের ভূমিকা, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলীর লেখা “বাংলাদেশের তারিখ”সহ বিভিন্ন ইতিহাস-ঘটনাক্রম গ্রন্থে প্রকৃত সত্য উপস্থাপন করা হয়েছে যে, জোরপূর্বক নয়, ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও তাদের পক্ষদৃষ্ট তিনটা মিথ্যাচারের জবাব বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমেরর “বঙ্গভবনের শেষ দিনগুলি” বইয়ে উল্লেখ আছে।
প্রথমত, জিয়াউর রহমান জোর করে প্রথমে সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন নাই। বিচারপতি সায়েম স্বেচ্ছায় তাঁকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এখানে সেটা তিনি স্পষ্ট করেই লিখেছেন।
দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমান জোর করে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা দখল করেন নাই। সায়েমের বিশেষ সহকারী বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ও তাঁর উপদেষ্টারাই তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখে তাঁকে জিয়াউর রহমানের অনুকূলে পদত্যাগের অনুরোধ জানান। কেউ তাঁকে কোনো জোরই করেন নাই। উল্টো ওনার দুজন ডাক্তারই ওনাকে প্রোস্টেটের চিকিৎসা করাতে বলেছিলেন এবং এরপর বিচারপতি সায়েম নিজেই পদত্যাগ করার চিন্তা করছিলেন।তৃতীয়ত, জিয়াউর রহমান অবৈধভাবেও ক্ষমতা দখল করেন নাই। আওয়ামী লীগ নেতা, শেখ মুজিবের এক কালের পরম বন্ধু যাকে জেতানোর জন্য কুমিল্লায় ভোট ডাকাতি করা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, সেই খন্দকার মোশতাকই খালেদ মোশাররফের নিয়োগ করা রাষ্ট্রপতি সায়েমকে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে প্রয়োজনে যেকোনো সঠিক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। সেই ধারাবলেই জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করেন বিচারপতি সায়েম।সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের “বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি” গ্রন্থের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সপ্তাহ খানিক আগে আমার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ আলী ও আমার সার্জন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আমাকে পরীক্ষা করে বললেন, আমার প্রোস্টেট অপারেশন করতে হবে। তাঁরা বললেন, ওষুধ কিছু চলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপারেশন করতেই হবে। কিছু ট্যাবলেট দেওয়া হলো, কিছুটা আরাম পাওয়া গেল। পরিস্থিতি ছিল এ রকম। আমি সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ দ্রুত হারাচ্ছিলাম। তখন আমি প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার চিন্তা করি।‘এএফপির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে তাঁরই উত্তরসূরি আরেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন—এ রকম একটি তথ্য বিকৃত করে অবাধে ছড়ানো হয়। মূল ইংরেজি বইটিতে জিয়া সম্পর্কে এ রকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।” অভিযোগের বিষয়টি সাজানো মিথ্যা বলে তথ্য পেয়েছে এএফপি। বইটির বাংলা অনুবাদক নিজেও সংস্থাটিকে জানিয়েছেন, এ নিয়ে যা ছড়ানো হয়েছে, তা বিভ্রান্তিকর। সাংবাদিক মশিউল আলম প্রেসিডেন্ট সায়েমের এই আত্মজীবনী ১৯৯৮ সালে বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি এএফপিকে বলেন, “যেটা ছড়ানো হচ্ছে, তা সাজানো মিথ্যা। আমিই বইটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছি। যা ছড়ানো হলো সে রকম কোনো কিছু মূল বইয়ে ছিল না।” বাংলাদেশের খ্যাতনামা ইতিহাস লেখক মহিউদ্দিন আহমদ এএফপিকে বলেন, “সায়েম তাঁর আত্মজীবনী বইয়ে কোথাও এ কথা বলেননি জিয়া বন্দুকের নলের মুখে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন। আমরাও এ ধরনের তথ্য কোথাও খুঁজে পাইনি।”‘বাস্তবতা হলো সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকার অপচেষ্টা কখনো সফল হয় না। রাষ্ট্রপতি সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করছেন জিয়াউর রহমান, এই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে লাভ নেই। বরং যাঁরা শহীদ জিয়াউর রহমানকে নিয়ে এহেন মিথ্যাচার ও তাঁর চরিত্র হননের কদর্যতায় লিপ্ত তাঁদেরকেই প্রত্যাখ্যান করে জনগণ। শহীদ জিয়া ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কোটি কোটি ভক্ত ও অনুরক্ত এবং দেশের জনগণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত এই যড়যন্ত্রকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে।’
প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে রাষ্ট্রপতি সায়েম অস্ত্রের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন। কী পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সায়েম পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা তাঁর বইতেই আছে। আর সেটাই প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধান সামরিক প্রশাসকের পদ ছেড়ে দেওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁর বইয়ের সেই অংশটুকু প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখায় ব্যবহার করা হয়েছে। আবার রাষ্ট্রপতি সায়েম যে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সে কথা বিএনপিরই প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ নিজের বইতে লিখেছেন। সে অংশটুকুও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি মূলত রাষ্ট্রপতি সায়েমের লেখাসহ প্রকাশিত কয়েকটি বইয়ের উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। অস্ত্রের মুখে পদত্যাগের কথা কোথাও নেই, অথচ বিএনপির প্রতিক্রিয়া সেটা ধরেই। এ ছাড়া এএফপির যে ফ্যাক্টচেক-এর কথা বলা হয়েছে, সেটিও অস্ত্রের মুখে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলসংক্রান্ত। সুতরাং এ বিষয়টি আসলে এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
<p>রানা মাহমুদ</p>
রানা মাহমুদ