সুদহার ও ডলারের দামের প্রভাব বাজারে ♦ বাড়তে পারে রেমিট্যান্স
বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করায় বাড়বে সব ধরনের ঋণের সুদহার। পাশাপাশি ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করায় বাড়বে আমদানি খরচও। একই দিনে এ দুই সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের মানুষের জীবনযাত্রা ও ব্যবসাবাণিজ্যে। উৎপাদন খরচ ও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে সর্বত্র। কারণ মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
এদিকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে বিদ্যমান আর্থিক প্রণোদনাসহ অ-আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর পরামর্শ এবং দেশের রিজার্ভ বাড়াতে সরকার প্রবাসীদের উপার্জিত বৈদশিক মুদ্রা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আনার জন্য এ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে বাড়তে পারে রেমিট্যান্স প্রবাহ। বিশ্লেষক ও উদ্যোক্তারা বলছেন, বাজারভিত্তিক সুদহার চালু করায় শিল্পকারখানার মালিকদের ঋণের সুদ আরও বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি পণ্যের দামও বাড়বে, চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর। ডলারের উচ্চমূল্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকেও প্রভাবিত করবে।ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণে ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) পদ্ধতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সুদহার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে সার্কুলার জারি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এখন থেকে ব্যাংকগুলো চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করতে পারবে। ফলে ব্যাংকগুলো গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ইচ্ছেমতো সুদ আরোপ করতে পারবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহার আরও বাড়বে। গত মাসে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এসে সর্বোচ্চ সুদের এ সীমা তুলে নেওয়া হয়। এর পর থেকে ঋণের সুদহার ক্রমাগত বেড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে দেশে ঋণের সুদহার বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। তবে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে, সুদ বাজারভিত্তিক হলেও তা যেন বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি না বাড়ে। একই সঙ্গে বেড়েছে নীতি সুদহার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি সব সময় ছোট, মাঝারিসহ সব ধরনের ব্যবসাকে কঠিন করে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের এমনিতেই ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে চায় না। এ কাগজ, সে কাগজ, ডান দিকে সই করো, বাম দিকে সই করো, এক মাস পরে আসো। কোনো দিন না করে দেয় না, বলে না তোমাকে ঋণ দেব না। সংকোচনমূূলক মুদ্রানীতি হলে ঋণ দেবেই না। এখন আমাদের উচিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে বেশি নজর দেওয়া।’
এ বিষয়ে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার বাজারভিত্তিক করেছে। অর্থাৎ সুদহার আরও বৃদ্ধি পাবে। যার প্রভাব পড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে এবং কর্মসংস্থানের ওপর।’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে ডলারের বিনিময় হারে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলারের দাম এক লাফে ৬ দশমিক ৩৬ বা ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর। নিঃসন্দেহে আমদানি পণ্যের দাম বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর। আমদানিকারকরা বেশি দরে পণ্য কিনলে বেশি দামেই বিক্রি করবে, কোনো ব্যবসায়ী লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না।’
এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি আমিন হেলালী বলেন, ‘আমাদের দেশ আমদানিনির্ভর। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপে আছে। এখন হঠাৎ করেই ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বাড়ানোর ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সব ক্ষেত্রে। বিশেষ করে নিত্যপণ্য আমদানিতে এর প্রভাব পড়বে। খরচ বেড়ে যাবে অনেক, এতে পণ্যের দামও বাড়বে।’ ব্যাংকাররা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় থেকে দেশে ডলারের সংকট চলছে। ৮৫ টাকার ডলার এখন ১১৭ টাকায় ঠেকেছে। টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ডলারের দাম বাড়ার কারণে বেড়েছে আমদানি পণ্যের দাম। সরাসরি প্রভাব ফেলেছে মূল্যস্ফীতিতে, যা দীর্ঘদিন ধরে ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘নগদ ডলারের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ ঠিক আছে। এখনে কে বিক্রি করবে কি করবে না, এটা তার নিজস্ব বিষয়। যারা মানি এক্সচেঞ্জে ডলার পায়নি, তারা ব্যাংকে গেলেই ডলার কিনতে পারবে। ব্যাংকগুলোর কাছে এখন ৫ কোটি নগদ ডলার মজুদ আছে।’
<p>রানা মাহমুদ</p>
রানা মাহমুদ