রিপোটার রানা মাহমুদঃ-বৃক্ষপ্রেমী মানুষ আবদুল ওয়াহিদ সরদার। যশোর সদর উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে হাজার হাজার গাছের চারা রোপণ করেছেন। এ জন্য পেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২১’। তিনিই আবার ২০১৮ সালে শুরু করেছেন গাছ লাগানো পেরেক তোলার মতো ব্যতিক্রমী কাজ। এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি গাছ থেকে প্রায় ৪৫০ কেজি পেরেক অপসারণ করেছেন ওয়াহিদ সরদার।
ছোট্ট একটি ঘটনা আবদুল ওয়াহিদ সরদারের জীবন যেন পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। ২০১৮ সালের ২৬ মে, শনিবার। গভীর রাত। রাস্তার পাশে একটি গাছের নিচে বসে ছিলেন তিনি। একসময় আনমনে গাছটি ধরে উঠে দাঁড়ালেন। গাছে লাগানো একটি পেরেক আচমকা তাঁর হাতে বিঁধল। তিনি লক্ষ করলেন, গাছের চারপাশে আরও পেরেক লাগানো। এসব পেরেকে ঝুলছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যানার ও সাইনবোর্ড। বোবা প্রাণীর শরীরে লাগানো পেরেকের ব্যথায় ব্যথিত হলেন আবদুল ওয়াহিদ সরদার। সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি গাছ থেকে এসব পেরেক তুলবেন।
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। গাছের শরীর থেকে পেরেক তোলার কাজে নেমে পড়লেন আবদুল ওয়াহিদ সরদার। ২০১৮ সালের ৪ জুলাই দুপুরে পুরোনো একটি বাইসাইকেলে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। সঙ্গে একটি পেরেক তোলার শাবল আর কাঠের ছোট একটি তক্তা। যশোর টাউন হল ময়দানের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে মেহগনিগাছ থেকে শাবল দিয়ে চারটি পেরেক তুললেন। ওই দিন তিনি আরও ১২টি গাছ থেকে ৫০টির বেশি পেরেক তোলেন। সেই শুরু, এরপর থেকে তিনি গাছের শরীর থেকে পেরেক তুলেই চলেছেন। যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহসহ ৭ জেলায় এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার গাছ থেকে প্রায় ৪৫০ কেজি পেরেক অপসারণ করেছেন। গাছ থেকে তোলা পেরেক তিনি সংরক্ষণ করেন।
খুলনা অঞ্চলের জেলার পর এখন তিনি ঢাকা বিভাগে প্রবেশ করেছেন। এখন আছেন রাজধানীতে। ১৮ জানুয়ারি কাকরাইল মোড়ে সাক্ষাৎ মিলল ওয়াহিদ সরদারের। মাথায় চিরচেনা লাল-সবুজের মাথাল। সঙ্গী পুরোনো একটি বাইসাইকেল। সাইকেলের সামনে একটি সাইনবোর্ড কায়দা করে বাঁধা। তাতে লেখা, ‘গাছ বাঁচলে আমরা সবাই বাঁচব’, ‘গাছের শরীরে তারকাঁটা, তার, নাইলন দড়ি, গাছের চরম ক্ষতিকারক’। ‘গাছে তারকাঁটা, পেরেক মারা আইনত অপরাধ’। সাইকেলের পেছনে থাকে একটি বস্তা, নানা আকারের ৫টি শাবল ও কাঠের ছোট তক্তা। এসব নিয়েই হাইকোর্ট এলাকার বিভিন্ন গাছ থেকে পেরেক তোলার কাজ করছেন তিনি। জানালেন, ঢাকায় থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে কাঁঠালবাগানে, এলাকার পরিচিত একজনের বাড়ি সেখানে, সে বাড়ির নিচতলায় থাকছেন। বলছিলেন, ‘এবার আমি ৪ নভেম্বর বাড়ি ছেড়েছি। ঢাকায় এসেছি কয়েক দিন হলো। ভেবেছিলাম, ঢাকার গাছের অবস্থা ভালো। কিন্তু এখানকার গাছের অবস্থা আরও খারাপ।’পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন আবদুল ওয়াহিদ সরদার (৫৮)। আড়াই বছর ধরে তিনি পুরোটা সময় পেরেক তোলার কাজই করছেন। আর্থিক অনটনের কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। অথচ গাছের জীবন, তাদের বেড়ে ওঠা ও জীবন বৈচিত্র্য নিয়ে তাঁর রয়েছে স্পষ্ট ধারণা। তাঁর বাড়ি যশোর সদর উপজেলার সাড়াপোল গ্রামে। আবদুল ওয়াহিদ সরদারের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে মিজানুর রহমান মালয়েশিয়াপ্রবাসী। ছোট ছেলে ওলিয়ার রহমান পড়াশোনা করে। মেয়ে নাছিমা খাতুনের বিয়ে হয়েছে।
আবদুল ওয়াহিদ সরদার শুধু পেরেক তোলেন, এমনটা নয়। নিজ উদ্যোগে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাস্তার পাশে, মসজিদ, মন্দির ও পতিত জায়গায় বিভিন্ন ফলদ বৃক্ষ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে একজন বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ওয়াহিদ সরদার জানান, যশোর সদর উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে নিজের টাকায় তিনি প্রায় ২০ হাজার ফলদ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করেছেন। এর মধ্যে সাড়ে ১৩ হাজার গাছ বেঁচে আছে। তাঁর এ কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ স্থানীয় কৃষকেরা নানা জাতের গাছ লাগানোসহ ফল চাষ করে পুষ্টির অভাব পূরণসহ কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তিনি বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। বনায়নের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২১’ লাভ করেন।
গাছের প্রতি এমন ভালোবাসা থেকেই হয়তো একসময় পেরেক অপসারণের কাজ শুরু করেন। এ কাজে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় আবদুল ওয়াহিদ সরদারকে। অনেকে তিরস্কার আর কটু কথা বলেন। অনেকে আবার জিজ্ঞেস করেন, তাঁকে গাছের পেরেক তুলতে কে অর্ডার দিয়েছে? তিনি কত বেতন পান?
ওয়াহিদ সরদার তখন প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, ‘গাছ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারকাঁটা, পেরেক, লোহার তার ও নাইলনের আঘাতে গাছ কষ্ট পাচ্ছে। অনেক জায়গায় গাছ মরে যাচ্ছে। বিজ্ঞান বলছে, গাছের জীবন আছে। আছে ব্যথা। আছে যন্ত্রণা। গাছের কষ্ট আমাকে ব্যথিত করে। এ জন্য আমি গাছের শরীর থেকে পেরেক অপসারণ করছি।’
কত দিন এ কাজ করেন যাবেন? ওয়াহিদ সরদারের চটপট উত্তর, ‘আমি সারা দেশে পেরেক তোলার কাজ করে যাব। এটা আমি যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্যানার ও সাইনবোর্ড জাদুঘরে না নেবে, ততক্ষণ আমি আমার যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’